চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে ৯ মাসে ১১ হত্যা
শহীদুল হুদা অলক, মনোহরপুর থেকে ফিরে
সীমান্ত দিয়ে গরু আনতে পারলেই হাতে আসে 'কাঁচা টাকা'। এই 'কাঁচা টাকা' পাওয়ার আশায় শিবগঞ্জের বিশ্বনাথপুরের একটি গরু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ১৭ সেপ্টেম্বর ভারত সীমান্তে যান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের রানীনগর গ্রামের গোলাম নবীর ছেলে সেনারুল (২৫)। কিন্তু টাকার বদলে বিএসএফের নির্যাতনের শিকার হয়ে তাঁর ভাগ্যে জুটেছে পঙ্গুত্ব। বিএসএফ সদস্যরা শালকাঠের মোটা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাঁর পা দুটো ভেঙে দেয়। পরে চোখ বেঁধে ফেলে দেয় পদ্মায়। প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলেও সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা কোনো দিন ভুলতে পারবেন না সেনারুল।
দেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে বছরের পর বছর ধরে বিএসএফের গুলিতে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও সামপ্রতিক সময়ে বিএসএফ সদস্যরা হত্যার পাশাপাশি অমানসিক নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৩৯ রাইফেল ব্যাটালিয়নের তথ্যানুযায়ী, চলতি মাসেই নির্যাতন করে হাত-পায়ের রগ কেটে পদ্মায় ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে দুই বাংলাদেশিকে। বিএসএফের নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। আর চলতি বছর নিহত হয়েছেন অন্তত ১১ জন।
৪ সেপ্টেম্বর বিএসএফের নির্যাতনের শিকার হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পথে মারা যায় সাহাপাড়া ডাকাতপাড়া গ্রামের সাইদুর (১৮)। ভারতের পদ্মার চর বিএসএফ ক্যাম্পের জওয়ানরা তাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করার পর হাত-পায়ের রগ কেটে পদ্মায় ফেলে দেয়। নদীতে ভেসে আসা সাইদুরকে উদ্ধারের পর সে তার স্বজনদের জানায় অমানসিক নির্যাতনের কথা।
বিএসএফের এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে ৩৯ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের পক্ষ থেকে ভারতের ১৫১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমানডেন্টের কাছে দুটি প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয় ৯ সেপ্টেম্বর। সাইদুরের পরিবারের বরাত দিয়ে এসব প্রতিবাদপত্রে সাইদুরের হাত-পায়ের রগ কাটার পাশাপাশি তার অণ্ডকোষ কেটে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে_'যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা প্রকাশ করার ভাষা জানা নেই... সীমান্তে নির্যাতন বন্ধ করা না হলে সমপ্রীতি ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েবে।'
এ ব্যাপারে ৩৯ রাইফেল ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জায়েদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিএসএফ যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে তা অমানবিক ও অনৈতিক। কেউ কোনো অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গুলি ও নির্যাতন করে মানুষ হত্যা করছে। বিডিআরের পক্ষ থেকে প্রতিটি ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সীমান্তে বিডিআর সতর্কাবস্থায় দায়িত্ব পালন করছে।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট উপজেলার ১২০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার প্রতিটি গ্রামের মানুষই বিএসএফের নির্যাতনের আতঙ্কে ভুগছে। শিবগঞ্জ, ভোলাহাটসহ সীমান্তের বহু কৃষক বিএসএফের হুমকির কারণে চাষাবাদ করতে পারেন না। ভোলাহাট উপজেলার মহনন্দা নদীর ভাঙন প্রতিরোধের কাজও বছরের পর বছর বন্ধ রাখতে হয়েছে একই কারণে। বিএসএএফের গুলিতে যারা নিহত হচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই গরু ব্যবসায়ী অথবা কৃষক। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলা গরু ব্যবসায়ীরা বিএসএফকে 'ম্যানেজ' করে নিয়মিত গরু আনেন। 'ম্যানেজে' গরমিল হলেই গুলি চলে। তাদের নির্যাতনে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও অস্ত্র বা মাদক ব্যবসায়ীদের ধরা পড়ার ঘটনা বিরল।
বিডিআরের তথ্যানুযায়ী, ওই ১২০ কিলোমিটার সীমান্ত পথের চোরাচালান প্রতিরোধ ও নিরাপত্তার জন্য দুটি ব্যাটালিয়ন কাজ করছে। এ জন্য সীমান্তে মোট ৩৫টি বিওপি স্থাপন করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে ৮৭ কিলোমিটার এলাকা দেখাশোনা করে ৩৯ রাইফেল ব্যাটালিয়ন। বাকিটুকুর দায়িত্বে আছে নওগাঁর ৪৩ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রতিটি বিওপিতে ১৫ থেকে ১৬ জন বিডিআর সদস্য থাকেন। ৮ ঘণ্টা করে দায়িত্ব ভাগ করলে প্রতিটি টহলে অংশ নিতে পারেন চার থেকে পাঁচজন। মাত্র চার-পাঁচজন সীমান্তরক্ষী দিয়ে এই বিশাল এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব হলেও লোকবল সমস্যার সমাধান হয়নি।
৩৯ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছে। বছরের প্রথম হত্যাকাণ্ডটি ঘটে শিংনগর সীমান্তে। ১৭২ নম্বর সীমানা পিলারের কাছে ৯ জানুয়ারি বিএসএফের গুলিতে মারা যান তারাপুর সাহাপাড়া গ্রামের আবদুল কাইউমের ছেলে মনিরুল ইসলাম। ২৮ জানুয়ারি বিএসএফের চাঁদনীচক ক্যাম্পের জওয়ানদের গুলিতে মারা যায় শিবগঞ্জের বিশরশিয়া গ্রামের নরেন কর্মকারের ছেলে শ্যামল কর্মকার (২০)। ২৫ ফেব্রুয়ারি ফতেপুর সীমান্তে ছত্রাজিতপুর বহালাবাড়ির মুকুল হোসেন (৪০), ২৩ মার্চ কিরণগঞ্জ সীমান্তের বিনোদপুরের একবারপুর গ্রামের তোজাম্মেল হক (৪২), ১২ এপ্রিল ওয়াহেদপুর সীমান্তে সূর্যনারায়ণপুরের কালুপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান হাবু (৩৩), ১৪ জুন ফতেপুর সীমান্তে বাবুপুরের শ্যামপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম (৪০), ২১ জুন চৌকা সীমান্তে আজমতপুরের হাজারবিঘি গ্রামের রবু মিয়া (৪০), ১৬ আগস্ট শিংনগর সীমান্তে মনাকষার পারচৌকা গ্রামের ফটিক (৩০) ও পিয়ালিমারী গ্রামের ইসমাইল হোসেন ইউসুফ (২৫) বিএসএফের গুলিতে মারা যান। ৪ সেপ্টেম্বর মনোহরপুর সীমান্তে ডাকাতপাড়ার সাইদুর ও ১৯ সেপ্টেম্বর একই সীমান্তে ঠুটাপাড়ার ফটিক (১৮) হন অমানসিক নির্যাতনের শিকার। ১১ বছরে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তেই ৬০ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। গত বছরও অন্তত ১০ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে বিএসএফের গুলিতে।
বিডিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, সীমান্তে বিএসএফ যে আচরণ করছে, তা কোনোভাবেই সভ্য মানুষের আচরণ হতে পারে না। তারা নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করছে, চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। বিএসএফের সামপ্রতিক নির্যাতন ও গুলির ঘটনায় বিডিআরের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। দফায় দফায় পতাকা বৈঠক হচ্ছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। পতাকা বৈঠকে বিএসএফ সীমান্তে সমপ্রীতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও বারবার ওয়দা ভেঙে গুলি চালাচ্ছে তারা।
No comments:
Post a Comment